বিপুল হাসান
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
‘এ যে ভারি রঙ্গ যাদু, এ যে ভারি রঙ্গ’, রঙ্গ নয়তো কী ! বেছে বেছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরকেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় ছবি মুক্তি চুড়ান্ত করা হলো? একে তো স্যাটেলাইটের কল্যাণে বোকা বাক্সে অবাধে দেখানো হচ্ছে ভারতীয় ছবি। এবার ধুঁকতে থাকা চলচ্চিত্র শিল্পকে বিজাতীয় করার আকাঙ্খায় প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় ছবি প্রদর্শণের পাঁয়তারা, তাও মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই।
সকল যুক্তি-আপত্তি তুচ্ছ করে চলতি বছরের জুলাইতে আইনের ফাঁক দিয়ে দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে প্রদর্শনের জন্য আমদানি করা হয় তিনটি ভারতীয় ছবি। ‘জোর’, ‘সংগ্রাম’ ও ‘বদলা’ নামের এ তিনটি ভারতীয় বাংলা ছবি বেশ কয়েকদিন আগে পেয়েছে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ডিসেম্বর থেকেই শুরু হচ্ছে ছবি তিনটি একে একে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এইসব ছবির আমদানীকারক ও এজেন্টরা ভারতীয় ছবিগুলো মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের সঙ্গে এখন শেষ মুহূর্তের কথাবার্তা বলছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও যশোরের অভিজাত কয়েকটি সিনেমা হলে আগামী ২৩ ডিসেম্বর ভারতীয় বাংলা ছবি ‘জোর’ মুক্তি দেওয়ার জন্য বুকিং দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় ছবি প্রদর্শণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আমদানীকারক ও পরিবেশকরা আরো ৯টি ভারতীয় ছবি আমদানীর প্রক্রিয়াও শুরু করে দিয়েছে। একই আইনের আওতায় অনাপত্তি পত্র পাওয়ার যোগ্য বলিউডের সুপারহিট ছবিগুলোর মধ্যে আছে দিলওয়ালা দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে, কুছ কুছ হোতা হ্যায়, কাভি খুশি কাভি গম, কাভি আল বিদা না কেহনা, মাই নেম ইজ খান, ওম শান্তি ওম, থ্রি ইডিয়টস ও দাবাং।
ভারতীয় ছবি আমদানী ও প্রদর্শনের ব্যাপারে শোনা যায়, নানা মুনির নানা মত। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক, প্রায় ৩৯ বছর পর কোন প্রক্রিয়ায় ছবিগুলো দেশে এসেছে এবং প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
যেভাবে ভারতীয় ছবি আমদানী হলো
দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থ রক্ষায় স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ ছিল। দীর্ঘদিন পর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় ছবি আমদানি ও প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ভারতীয ছবি প্রবেশের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি নীতিমালার বাধা নিষেধ তুলে নেয়। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দেশীয় চলচ্চিত্রের পরিচালক-প্রযোজক ও শিল্পী-কলাকুশলীরা প্রবল আপত্তি জানান এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন। চলচ্চিত্রশিল্পী, কলাকুশলী ও নির্মাতাদের এই আপত্তির মুখে সরকার ভারতীয় ছবি আমদানির ওপর পুনরায় বিধিনিষেধ আরোপ করে।
সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আমদানিকারক ও প্রদর্শকরা উচ্চ আদালতে রিট আবেদন জানান। আদালতের নির্দেশে উল্লেখিত সময় যেসব ছবি আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়, সেসব ছবিকে তথ্য মন্ত্রণালয় অনাপত্তিপত্র দেয়। এই অনাপত্তিপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম দফায় তিনটি ভারতীয় বাংলা ছবি আমদানী করা হয়। পরবর্তীতে ছবি তিনটি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়ার পর এখন এগুলো মুক্তি দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আগেই ঋণপত্র খোলার অজুহাত দেখিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে আরো ৯টি ভারতীয় ছবি আমদানীর।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতি, পরিচালক সমিতি ও শিল্পী সমিতিসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন শুরু থেকেই ভারতীয় ছবি আমদানী ও প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের বিরোধিতা করে আসছে। বিশেষ করে প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির পক্ষ থেকে হুশিয়ারী জানানো হয়েছে, যেসব সিনেমা হলে ভারতীয় ছবি প্রদর্শন করবে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে এবং পরবর্তীতে এসব সিনেমা হলে বাংলাদেশী ছবি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে।
ভারতীয় ছবি আমদানী ও প্রেক্ষাগৃহে প্রদশর্নের বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র শিল্পী-কলাকুশলীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদ। কিছুদিন আগে এই পরিষদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরা সবসময় সুবিধাভোগী। তাঁরা কখনোই লোকসান দেন না। একটি ছবির ব্যবসা খারাপ হলেও তাদের কোনো লোকসান দিতে হয় না। অথচ প্রযোজক লোকসান দিয়েও ছবি তৈরি করেন। সেখানে প্রদর্শকেরা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র আনতে চান।
পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য
বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রর্দশনের জন্য ভারতীয় ছবি আমদানী প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেই। এসব আলোচনা-সমালোচনা থেকে নির্বাচিত কিছু উক্তি তুলে ধরা হলো।
‘বাংলাদেশের ছবির প্রযোজকরা বলেছেন, ভারতীয় ছবি বাংলাদেশে এলে বাংলাদেশের ছবির বারোটা বেজে যাবে। প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারব না। আইন করে আমাদের প্রতিযোগিতার বাইরে রাখতে হবে। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুও আমাদের প্রটেকশন দিয়েছেন, ইত্যাদি। সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট বলে যে কথাটি আছে আমাদের দেশে চিত্র নির্মাতা সেটা জানেন না। এই দেশের আইন হলো আনফিটকে সারভাইভ করার সুযোগ দেওয়া। এরচেয়ে হাস্যকর কিছু হতে পারে বলে আমি মনে করি না।’ –কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ
‘ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্র আমাদের দেশে আসা মানে, আমাদের নিজস্ব যে সংস্কৃতি আছে, সেটুকুও শেষ হয়ে যাওয়া।’ – নায়করাজ রাজ্জাক
‘পাকিস্তানে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের ফলে সে দেশের চলচ্চিত্রশিল্প রুগ্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া এ দেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা হবে আরো করুণ। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের অস্তিত্ব হবে হুমকির সম্মুখিন।’ – চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম
‘এদেশে বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে এফডিসি নির্মাণ করেছিলেন, সেটাও আর থাকবে না।’ – নায়ক আলমগীর
‘দুই দেশের মধ্যে একটা বিনিময়চুক্তি হতে পারে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে আমাদের দেশ থেকে তারা বাংলা ছবি নেবে, তবেই আমরা তাদের দেশ থেকে বাংলা ছবি আনতে পারি। হয়তো সেখানে বছরে কয়েকটি হিন্দি ভালো ছবি আসতে পারে। দুই দেশের মধ্যে চলচ্চিত্র বিনিময়ে অবশ্যই ভারসাম্য থাকতে হবে।’ – চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম
‘সেন্সর পাওয়া ছবিগুলো প্রদর্শনে কোনো আইনগত বাধা নেই। শিগগিরই আমরা ভারতীয় ছবির প্রদর্শনী শুরু করতে পারব। বন্ধ হওয়া প্রেক্ষাগৃহগুলো আবারও চালু হবে।’ – চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কেএমআর মঞ্জুর
‘সিনেমা হলের ট্যাক্স, বিদ্যুৎ খরচ, স্টাফদের বেতন এবং অন্যান্য খরচ হিসেব করলে এখন কোনোভাবেই সিনেমা হল মালিকরা ব্যবসা করতে পারছেন না। কালেভদ্রে দু’একটি সিনেমা ব্যবসা করলেও এতে সিনেমা হল বাঁচবে না। সিনেমা হলের পরিবেশ ঠিক করার জন্য নতুন করে সিনেমা হল মালিক লগ্নি করতে চান না। এমনিতে লোকসান, তারপর আবার লগ্নি? সরকার সিনেমা হলের ট্যাক্স কমালে হয়তো কিছুটা সমস্যার সমাধান হতো। কিন্তু সরকার ট্যাক্স কমানোর পক্ষে কোনো আশ্বাস দেয়নি। যে কারণে সিনেমা হলকে বাঁচাতে আমরা ভারতীয় ছবি আমদানি ও প্রদর্শনের পক্ষে।’
– চলচ্চিত্র পরিবেশক সমিতির নেতা ও সিনেমা হল মালিক সফর আলী ভূঁইয়া‘দেশের বেশিরভাগ সিনেমা হলের প্রজেক্টর মেশিন খারাপ। জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। এতে করে প্রিন্টেরও ক্ষতি হচ্ছে। পর্দা পরিষ্কার করা হয় না বলে ছবি ঘোলা দেখা যায়। সাউন্ড সিস্টেমের কোনো উন্নতি হয়। সিনেমা হল মালিকরা কোনো রকমে দায়সারাভাবে সিনেমা প্রদর্শন করছেন। সাধারণ দর্শক না বুঝে আমাদের গালমন্দ করছে। একই সিনেমা আপনি পূরবী বা আনারকলিতে দেখে যদি মধুমিতা বা বলাকায় আবার দেখেন তাহলে পার্থক্যটি সহজেই বোঝা যাবে। পারিবারিক দর্শকদের সিনেমা হলে ফিরিয়ে আনতে সিনেমা হল মালিকদেরই কোনো উদ্যোগ নেই। শুধু সিনেমার মানের দোহাই দেয়া হচ্ছে!’ – পরিচালক ও পরিচালক সমিতির মহাসচিব এফ আই মানিক
অবস্থা পর্যবেক্ষণ
চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ অনেকেই মনে করছেন, উল্লেখিত ভারতীয় ছবিগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের বিষয়টি একধরণের পর্যবেক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করেছে সংশ্লিষ্টরা। তারা দেখতে চাচ্ছে, ভারতীয় ছবিগুলো কীভাবে গ্রহণ করে বাংলাদেশের দর্শকেরা। যদি ছবিগুলো বাণিজ্যিক সাফল্যের মুখ দেখে, তবে আমদানিকারক আর পরিবেশকরা এটি নিয়মিত রাখতে গ্রহণ করবেন জোর পদক্ষেপ। নির্মাতা-পরিচালক- শিল্পী পরিবেশকরা মনে করছেন, বড় মাছ যেমন ছোট মাছ গিলে খায়, তেমনি ভারতীয় ছবিও প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শন করা হলে তা ধ্বংশ করে দিবে দেশীয় চলচ্চিত্রকে। কারণ বিনিয়োগ আর বাজার, দু দিক থেকেই ভারতীয় ছবির ধারে কাছে নেই আমাদের চলচ্চিত্র। এ এক অসম প্রতিযোগিতা।
টেস্ট কেস হিসেবে হলেও বিজয়ের মাসে কেনো প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় ছবি মুক্তি দেওয়া হচ্ছে? এই প্রশ্নটিই এখন জোড়ালো হয়ে ওঠেছে। একইভাবে যদি ভাষা আন্দোলনের মাস আগামী ফেব্রুয়ারিতে যদি প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি ছবি মুক্তি দেওয়া হয়, তাহলে জাতীয় চেতনা বলে থাকলোটা কী!
Filed under: Bangladesh and India, Bangladesh Liberation War, Culture, Featured, Politices, Strange, Unknown History | Tagged: ইতিহাস, বাংলাদেশ, Bangladesh, Bengali language, Bollywood, Cultural Aggression, Dallywood, India, Indian Aggression, Indian Film Industry, Theatre, Victory Month |
Leave a comment